বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনা। ওই ঘটনায় দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিকসহ দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা নিষ্ঠুর ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। পরে এ ঘটনার মামলায় বিচারিক আদালতের পর ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাত জঙ্গিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এরপর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে সেখানে উঠে আসে আসামিদের সাজা কমানোর ক্ষেত্রে হাইকোর্টের বিচারিক বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ।
ঘটনাসূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি।
চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার জেরে গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। পরে মামলার তদন্ত শেষে আট আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়। টানা এক বছর মামলার বিচার শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালত তার রায়ে ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও একজনকে খালাস দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- হামলার মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ রায়ের পর নিয়ম অনুসারে ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও খালাস চেয়ে করা আসামিদের জেল আপিল শুনানির জন্য মামলার নথিপত্র বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টে আসে। বিচারিক আদালতের এসব নথির মধ্যে মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা, চার্জশিট, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও রায়সহ মোট ২ হাজার ৩০৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় জমা করা হয়। এরপর বিচারিক আদালত থেকে আসা মামলাটির সব নথিপত্র একত্রিত করে আপিল শুনানির জন্য উত্থাপনের জন্য পেপারবুক তৈরি শেষে মামলাটি শুনানিতে ওঠে। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে হাইকোর্টে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। যা শেষ হয় একই বছরের ১১ অক্টোবর। পরে ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাত জঙ্গিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট। দণ্ডিতরা হলো-জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। সম্প্রতি হাইকোর্টের ওই রায়ের ২২৯ পৃষ্ঠার অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আসামিদের সাজা কমানোর পেছনে কিছু কারণ তুলে ধরেছেন আদালত।
রায়ে আদালত বলেছেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ৫ জন সন্ত্রাসী (রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল) সরাসরি উপস্থিত থেকে আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছেন। ‘২২ জন নাগরিককে হত্যা করেছে বলে প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে ওই পাঁচজন সন্ত্রাসী অপরাধী। স্বীকৃতমতে, ওই ৫ সন্ত্রাসী ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে যদি কেউ বেঁচে থাকতেন তাহলে তাকে এই আইনের অধীনে বিচার শেষে ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতো।’ বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কমানোর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, এটা স্বীকৃত যে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে ঘটনাটি ঘটানোর উদ্দেশ্যে আপিলকারীদের কেউ উপস্থিত ছিল না কিংবা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ঘটনাটি ঘটানোর জন্য কোনও প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অভিযোগ এই আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বিচারিক আদালত ‘একই অভিপ্রায়ের’ বিষয়টি উল্লেখ করে আপিলকারীদের (সাত আসামি) সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তা সঠিক নয় বলে আমরা মনে করি। আপিলকারী আসামিদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ওই আইনের ৬(২)(অ) ধারায় দণ্ড প্রদান (মৃত্যুদণ্ড) করা সঠিক হয়নি বলে রায়টি (বিচারিক আদালতের রায়) হস্তক্ষেপযোগ্য।
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, আপিলকারী আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ, বাছাই, নিয়োগ ও দীর্ঘদিন গোপন স্থানে রেখে শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করার কারণে ওই ৫ সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আপিলকারী আসামিদের অপরাধের ক্ষেত্রে ৬(১)(ক)(আ) ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে বলে আমরা মনে করি। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ ও রহিত করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(আ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে (সাত আসামি) আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। মূলত হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। তবে এ বিষয়ে কোনও অগ্রগতি রয়েছে কিনা তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

হোলি আর্টিজান হামলা
যেসব কারণে হাইকোর্টে আসামিদের সাজা কমলো
- আপলোড সময় : ০২-০৭-২০২৫ ০৮:১৯:০৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৭-২০২৫ ০৮:১৯:০৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ